Thursday, May 12, 2016

কিডনি নস্ট হবার লক্ষণগুলো কী কী

কিডনি নস্ট হবার লক্ষণগুলো কী কী

 কিডনির প্রাথমিক রোগে বা অন্য কোনো কারণে কিডনি আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ধরে যদি দুটো কিডনিরই কার্যকারিতা নষ্ট হতে থাকে তখন তাকে ক্রনিক বা ধীরগতিতে কিডনি ফেইলুর (Kidney Failure) বলা হয়। একটি কিডনি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকলে এবং অপরটির কার্যকারিতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেলেও সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। দুটো কিডনিরই শতকরা ৫০ ভাগ বিনষ্ট হলেও শরীর সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে, যার ফলে একজন সুস্থ মানুষ (কিডনি ডোনার – Kidney Donor) তার নিকট আত্মীয় বা অন্য আর একজন কিডনি বিকল রোগীকে (কিডনি গ্রহণকারী) একটি কিডনি দান করেও সুস্থ থাকেন, স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। কেবল দুটো কিডনির ৫০ ভাগের উপর নষ্ট হলেই কিডনি বিকল হওয়ার প্রবণতা শুরু হয় এবং ৭৫ ভাগ নষ্ট হলেই শরীরের লক্ষণগুলো ধরা যেতে পারে আর ৯৫ ভাগের উপর নষ্ট হলে কৃত্রিম উপায়ে (ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজন) ছাড়া রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না, যাকে বলে এন্ড স্টেজ রেলাল ফেইল্যুর (End Stage Renal Failure)।
                                

কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ

১. গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস বা কিডনির ছাকনি প্রদাহ রোগ ৫০-৫৫%।
২. ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ ১৫-২০%।
৩. উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনি রোগ ১০-১৫%।
৪. কিডনি বা প্রস্রাবের রাস্তায় পাথর ও অন্য কোনো কারণে বাধাজনিত রোগ ৭-১৯%।
৫. কিডনি বা প্রস্রাবের রাস্তায় জীবাণুজনিত রোগ ৫-৭%।
৬. বংশানুক্রমিক কিডনি রোগ ৩-৫%।
৭. ওষুধজনিত কিডনি রোগ ৩-৫%।
৮. অন্যান্য ও অজানা।

কিডনি নস্ট হবার উপসর্গ

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, দুটো কিডনির শতকরা পঁচাত্তর ভাগ কার্যকারিতা নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত কিডনি বিকলের উপসর্গ দেখা যায় না। রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে সামান্য ধরনের কিডনি রোগ থাকার দরুন গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না। শতকরা ৭৫ ভাগের উপর কিডনি অকেজো হয়ে গেলে রোগীর ক্ষুধা মন্দা, আহারে অনীহা, বমি বমি ভাগ, বমি হওয়া, শরীর ক্রমান্বয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। এছাড়াও প্রস্রাবের পরিমাণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, রাতে প্রস্রাব করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কোনো রকম চর্মরোগের উপসর্গ ছাড়াই শরীর চুলকায়, যখন তখন হেচকি ওঠে এবং অনেক ক্ষেত্রে খিঁচুনি হতে পারে। রোগী শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট, তীব্র গতিতে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, ঝিমানো ভাব, এমনকি এক পর্যায়ে রোগী জ্ঞানও হারিয়ে ফেলতে পারে।
রোগীকে পরীক্ষা করে রক্তের স্বল্পতা বোঝা যায়। অধিকাংশ রোগীর উচ্চরক্তচাপ (Hypertention) ধরা পড়ে। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর কারণ সাপেক্ষে শরীরে পানি দেখা যেতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে চামড়া শুকিয়ে যেতে পারে। কিছু কিছু রোগীর হৃিপণ্ডের আবরণে পানি এবং হার্ট ফেইলুরের চিহ্ন দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে শরীরের এমন কি হাত-পায়ের মাংসপেশী শুকিয়ে যায় যার দরুন রোগী সাধারণত চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলে।

কিডনি নস্ট রোগ নির্ণয়

ক্রনিক রেনাল ফেইলুর (Chronic Renal Failure) রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াও প্রাথমিকভাবে রক্তের ইউরিয়া (Serum Urea), ক্রিয়েটেনিন (Serum Creatinin) এবং ইলেকট্রোলাইট (Electrolyres)পরীক্ষা করা হয়। কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তের ইউরিয়া, ক্রিয়েটেনিন বেড়ে যায়। পটাশিয়ামের পরিমাণ বাড়তে থাকে ও বাইকার্বোনেট কমে যায়। এছাড়াও ফসফেট শরীরে জমতে শুরু করে, যার ফলে ক্যালসিয়াম কমে যেতে বাধ্য হয় এবং অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও শুরু হতে থাকে। এরপরে কি কারণে ধীরগতিতে কিডনি বিকল হয়েছে তা বের করার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষা করে এ্যালবুমিন (Albumin) আছে কিনা তা দেখা হয় এবং লোহিত ও শ্বেত কণিকা আছে কিনা তাও দেখে নেয়া হয়। প্রয়োজনের ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাবের প্রোটিনের পরিমাণও দেখা হয়। প্রস্রাবে এ্যালবুমিন ২৪ ঘণ্টায় এক গ্রামের বেশি হলে প্রাথমিকভাবে কিডনি ফেইলুরের কারণ হিসেবে গ্লোমারুলোনেফ্রাইটিস ধরে নেয়া হয়।
কিডনির গঠন প্রণালী দেখার জন্য আলট্রাসনোগ্রাম এবং পেটের প্লেইন এক্স-রে করা হয়ে থাকে। কিডনির কার্যকারিতা শেষ পর্যায়ে গেলে দুটো কিডনির আকৃতি স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হয়ে যায়। যার কারণ গ্রোমারুলোনেফ্রাইটিস বা জীবাণুজনিত বলে মনে করা হয়। কিডনির আকৃতি ছোট না হয়ে যদি বড় হয়ে যায় এবং ভেতরের ক্যালিসেস বা শাখা-প্রশাখা নালীসমূহ ফুলে যায় তাহলে অবস্ট্রাকটিভ ইউরোপ্যাথিকে কিডনি বিকলের কারণ হিসেবে ধরা হয়। দুটো কিডনিতে যদি অনেকগুলো সিস্ট থাকে তাহলে বংশানুক্রমিক কিডনি রোগ বা পলিসিসটিক কিডনি ডিজিজ (Polycystic Kidney Disease) ভাবা হয়। এছাড়া পাথরজনিত কারণে বা প্রোস্টেটজনিত জটিলতায় কিডনি বিকল হলো কিনা তাও আলট্রাসনোগ্রাম ও এক্স-রের মাধ্যমে ধরা যেতে পারে।
উল্লিখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও কিডনি বিকল রোগীদের হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস, সি-ভাইরাস, এইডস (AIDS) ভাইরাস আছে কিনা তাও দেখা প্রয়োজন। বুকের এক্স-রে, ইসিজি রক্তের হিমোগ্লোবিন, ব্লাড গ্রুপ, এইচএলএ টিস্যু এন্টিজেন এসব পরীক্ষাও বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়।

কিডনি নস্ট হবার চিকিত্সা ও প্রতিকার

কিডনি অকেজো রোগীর চিকিত্সা নির্ভর করে কি কারণে এবং কত পরিমাণে কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হয়েছে তার উপর। কেননা এমন অনেক কারণ রয়েছে যেগুলোকে আমরা সঠিক চিকিত্সার মাধ্যমে ভালো করে দিতে পারি, যেমন বাধাজনিত কিডনি রোগ। আবার কিছু কারণ আছে ভালো করা না গেলেও কিডনি আরো বেশি অকেজো না হয়ে যায় তার ব্যবস্থা নিতে পারি, যেমন উচ্চরক্তচাপ। অবশ্য যে কোনো কারণেই হোক না কেন দুটো কিডনির শতকরা ৯৫ ভাগের উপরে যদি নষ্ট হয়ে যায় তখন কোনোভাবেই কিডনির কার্যকারিতা ফেরানো সম্ভব হয় না। আর এসব ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পড়ে ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে চিকিত্সার ব্যবস্থা করা। উল্লেখিত দু ধরনের চিকিত্সাই অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্যই প্রয়োজন সঠিক সময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের মাধ্যমে কিডনি রোগের চিকিত্সা করানো। এর জন্য প্রয়োজন কিডনি রোগ সম্পর্কে সমাজ সচেতনতা, প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করা ও চিকিত্সা সেবার মান বৃদ্ধি করা। কেননা প্রতি বছর আমাদের দেশে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার কিডনি রোগী কিডনি অকেজো হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এদের বাঁচাবার জন্য চাই চিকিত্সার সুযোগ-সুবিধা।
শুধু সরকারি পর্যায়ে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা সম্ভব নয়। তাই এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি উদ্যোক্তাকে ও সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিবর্গকে। তৈরি করতে হবে অত্যাধুনিক ডায়ালাইসিস এবং কিডনি সংযোজনের ব্যবস্থা। আর কিডনি সংযোজনের জন্য নিকট আত্মীয়দের মধ্য থেকে ডোনার হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা দুটো সুস্থ কিডনির মধ্যে একটা নিকট অসুস্থ কিডনি রোগীকে দান করলেও স্বাভাবিক সুস্থ জীবন-যাপন করা যায় এবং সেক্ষেত্রে সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। তাহলেই হাজার হাজার কিডনি বিকল রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

0 comments:

Post a Comment